মোঃ আলী শেখ, সিনিয়র স্টাফ রিপোর্টার :
লেখক >মো: ইমতিয়াজ চৌধুরী,অফিসার, ইসলামী ব্যাংক বাংলাদেশ পিএলসি।
সমাজের এক অদৃশ্য মেরুদণ্ডের নাম শ্রমজীবী মানুষ। তারা কোলাহল ময় শহরের নিঃশব্দ কারিগর, গ্রামের শান্ত জীবনের অদম্য নায়ক। সকালবেলা যখন শহরের অলিতে-গলিতে মানুষের পদচারণা শুরু হয়, তার অনেক আগে থেকেই তারা কর্মস্থলে পা ফেলেন। কেউ ঠেলাগাড়ি ঠেলে, কেউ রিকশার প্যাডেল ঘুরিয়ে, কেউ আবার বস্তা বয়ে কিংবা মেশিন চালিয়ে জীবনের যুদ্ধ শুরু করেন। এই জীবন যুদ্ধের কোনো শেষ নেই, নেই কোনো স্থিরতা, কেবলই প্রয়োজন আর সংগ্রামের শেকলে বাঁধা এক অবিরাম চলা।
তাদের জীবনে নেই আরাম আয়েশের ছায়া। চারদিকে যেন কেবলই হিসেবের অংক—আজ কতটুকু আয় হবে, বাজারের দাম কত, ছেলেমেয়ের স্কুলের ফি জমা দেওয়া যাবে কি না, অসুস্থ স্ত্রীর ওষুধ কেনা সম্ভব হবে তো? একবেলার খাবার জোগাড় করতে গিয়ে কখনো কখনো দিনের দুবেলা ফাঁকা পড়ে থাকে। অথচ এই মানুষগুলোই জাতির ভিত নির্মাণ করে, উন্নয়নের ইট-পাথর জোগাড় করে।
শ্রমজীবী মানুষের জীবনে স্বপ্ন থাকে, কিন্তু সে স্বপ্ন যেন এক কুয়াশাচ্ছন্ন ভোরের মতো—ধরা দেয়, আবার মিলিয়ে যায়। একজন পিতা চান তার সন্তান যেন তার মতো গাঁইট মাথায় না তোলে, বরং বইয়ের পাতায় জীবন গড়ে তোলে। কিন্তু বাস্তবতা বড় নিষ্ঠুর। অর্থনৈতিক অনিশ্চয়তা, সামাজিক অসহযোগিতা এবং রাষ্ট্রীয় অবহেলায় সেই স্বপ্নগুলো ঝরে যায় অঙ্কুরেই। কেউ কেউ বাধ্য হয়ে স্কুল ছেড়ে পাটের গুদামে, গার্মেন্টসে কিংবা হোটেলে ঢুকে পড়ে।
যে সমাজে শ্রমিকের অধিকার শুধুমাত্র কাগজে সীমাবদ্ধ, সেখানে শ্রমিকের মর্যাদা কল্পনা করা কঠিন। শ্রম আইন আছে, কিন্তু তার প্রয়োগ নেই। ন্যূনতম মজুরি নির্ধারিত হলেও অনেকেই তা পান না। নিরাপদ কর্মপরিবেশের কথা বলা হয়, কিন্তু বাস্তবে অনেক ক্ষেত্রেই তা এক অলীক কল্পনা মাত্র। শ্রমজীবী মানুষদের নেই কোনো স্থায়িত্ব, নেই ভবিষ্যতের নিশ্চয়তা। শুধু আজকের দিনটাই যেন একমাত্র উপলব্ধি।
তারপরও শ্রমজীবী মানুষের মুখে হাসি থাকে। খুব সাধারণ এক থালায় ভাত আর ডাল খেয়েও তারা তৃপ্তি খুঁজে পান। একে অপরকে সাহায্য করেন, প্রতিবেশীর বিপদে এগিয়ে আসেন। এই সহানুভূতি, এই মানবিকতা হয়তো কোনো বড় শিক্ষার পাঠ্যবইতে লেখা নেই, কিন্তু এই মানুষগুলোর প্রতিদিনের জীবনে তা উজ্জ্বল হয়ে ধরা দেয়।
তাদের কথা উঠলে অনেকেই উন্নয়নের গল্প বলেন, পরিসংখ্যানের অঙ্কে বোঝাতে চান সমাজ কতটা এগিয়েছে। কিন্তু সেই অগ্রগতির পেছনে শ্রমিকের ঘাম শুকিয়ে যায়, রক্ত ঝরে। অথচ উন্নয়নের আলো খুব কম সময়েই এসে পড়ে সেই টিনের চালা ঘরে, যেখানে এক শিশুর কান্না ভেসে আসে অনাহার কিংবা অপুষ্টির যন্ত্রণায়।
শ্রমজীবী মানুষের এই জীবন-সংগ্রাম থেকে মুক্তির উপায় কী? প্রয়োজন একটি মানবিক রাষ্ট্র, একটি দায়িত্বশীল সমাজ। যে রাষ্ট্র শ্রমিকের কণ্ঠ শোনে, তার ঘামের দাম দেয়, তার বেঁচে থাকার নিশ্চয়তা দেয়। প্রয়োজন এমন এক সমাজ, যেখানে শ্রমিক হওয়া লজ্জার নয়, বরং গৌরবের। একটি সভ্যতা তখনই পরিপূর্ণ হয়, যখন তার প্রতিটি স্তরের মানুষ মর্যাদার সাথে বাঁচতে পারে।
শ্রমজীবী মানুষ শুধুমাত্র একটি শ্রেণি নয়, তারা এক বিশাল জনপদের প্রতিচ্ছবি। তাদের স্বপ্ন, কষ্ট, প্রেম, প্রতিবাদ—সবকিছু মিলিয়েই এক জীবন্ত সাহিত্য। সেই সাহিত্যে আছে চোখ ভেজানো বেদনা, আবার আছে জীবন জয়ের মহাকাব্যও। তাদের চোখে প্রতিদিন সূর্য ওঠে নতুন আশা নিয়ে, আর ডুবে যায় নিঃশব্দ স্বপ্নভঙ্গে। তবুও তারা বেঁচে থাকে, লড়াই করে, সমাজকে এগিয়ে নিয়ে যায়।
এই শ্রমজীবী মানুষের জীবনব্যবস্থার উন্নয়ন না হলে কোনো উন্নয়নই টেকসই নয়। তাই এখন সময় এসেছে তাদের প্রতি দায়িত্ব পালনের, তাদের অধিকার ফিরিয়ে দেওয়ার। কারণ তারাই এই সমাজের মৌল ভিত্তি, যাদের কাঁধে ভর করেই দাঁড়িয়ে আছে সভ্যতার উচ্চ মিনার।