বিশেষ প্রতিনিধি,
দেশের বাণিজ্যিক রাজধানী ও অন্যতম গুরুত্বপূর্ণ জেলা চট্টগ্রামের জেলা প্রশাসক (ডিসি) পদে নিয়োগকে কেন্দ্র করে জনপ্রশাসনে ব্যাপক তোলপাড় সৃষ্টি হয়েছে। নওগাঁর বর্তমান জেলা প্রশাসক মোহাম্মদ আব্দুল আউয়ালকে এই লোভনীয় পদে বদলি করা হলেও এর নেপথ্যে রয়েছে ২২ কোটি টাকার লেনদেন, ক্ষমতার অপব্যবহার এবং প্রভাবশালী মহলের তদবিরের মতো বিস্ফোরক অভিযোগ। এই ঘটনার জের ধরে এরই মধ্যে পদ হারাতে হয়েছে জনপ্রশাসন মন্ত্রণালয়ের সিনিয়র সচিব মো. মোখলেস উর রহমানকে।
অনুসন্ধানে জানা যায়, জনপ্রশাসন মন্ত্রণালয় সূত্রে জানা যায়, নওগাঁর জেলা প্রশাসক মোহাম্মদ আব্দুল আউয়ালকে চট্টগ্রামের মতো গুরুত্বপূর্ণ জেলায় বদলির পেছনে আইন, বিচার ও সংসদবিষয়ক উপদেষ্টা আসিফ নজরুলের সরাসরি তদবির ছিল। অনুসন্ধানে একটি বিশ্বস্ত সূত্র নিশ্চিত করেছে, এই নিয়োগ চূড়ান্ত করতে মোট ২২ কোটি টাকার চুক্তি হয়। চুক্তি অনুযায়ী, যোগদানের আগেই নগদ ৬ কোটি টাকা পরিশোধ করা হয়েছে। বাকি ১৬ কোটি টাকা মোহাম্মদ আব্দুল আউয়াল চট্টগ্রামের জেলা প্রশাসক হিসেবে দায়িত্ব পালনের সময় বিভিন্ন খাত থেকে 'আয়' করে পরিশোধ করবেন বলে সমঝোতা হয়েছে।
সূত্রটি আরও দাবি করে, পরিশোধিত নগদ ৬ কোটি টাকার মধ্যে আইন উপদেষ্টা আসিফ নজরুল নিজে নিয়েছেন ৪ কোটি টাকা এবং জনপ্রশাসন মন্ত্রণালয়ের সিনিয়র সচিব মো. মোখলেস উর রহমানকে দেওয়া হয়েছে ২ কোটি টাকা।
চট্টগ্রামের জেলা প্রশাসক পদের জন্য আসিফ মাহমুদ এবং তালাত মাহমুদেরও নিজস্ব প্রার্থী ছিল বলে জানা গেছে। কিন্তু তাদের প্রভাব ও তদবিরকে অগ্রাহ্য করে উপদেষ্টা আসিফ নজরুলের প্রার্থী মোহাম্মদ আব্দুল আউয়ালের নিয়োগ চূড়ান্ত করা হয়। এতে ক্ষুব্ধ হয়ে আসিফ মাহমুদ সরাসরি প্রধান উপদেষ্টা ড. মুহাম্মদ ইউনূসের কাছে জনপ্রশাসন সচিব মো. মোখলেস উর রহমানের বিরুদ্ধে আর্থিক লেনদেন ও অনিয়মের মাধ্যমে নিয়োগ দেওয়ার অভিযোগ করেন।
এই নালিশের পর গতকাল রবিবার জনপ্রশাসন মন্ত্রণালয়ে নাটকীয় পরিবর্তন আনা হয়। সিনিয়র সচিব মো. মোখলেস উর রহমানকে তার পদ থেকে সরিয়ে দেওয়া হয়। তাকে পরিকল্পনা কমিশনের সদস্য (সিনিয়র সচিব) হিসেবে বদলি করা হয়েছে, যা প্রশাসনে একটি 'ডিমোশন পোস্ট' বা কম গুরুত্বপূর্ণ পদ হিসেবে বিবেচিত। এই আকস্মিক বদলিকে প্রশাসনে চলমান ক্ষমতার দ্বন্দ্ব এবং ডিসি নিয়োগে দুর্নীতির ফল হিসেবেই দেখছেন সংশ্লিষ্টরা।
সিনিয়র সচিব মো. মোখলেস উর রহমানের বিরুদ্ধে ডিসি নিয়োগে দুর্নীতি ও অনিয়মের অভিযোগ এবারই প্রথম নয়। এর আগেও তার বিরুদ্ধে বিভিন্ন সময়ে জেলা প্রশাসক নিয়োগে আর্থিক লেনদেনের অভিযোগ উঠেছিল। এ বিষয়ে দেশের অন্যতম জনপ্রিয় পত্রিকা 'দৈনিক কালবেলা' একটি বিস্তারিত অনুসন্ধানী প্রতিবেদন প্রকাশ করেছিল, যা তখন প্রশাসনে ব্যাপক আলোচনার জন্ম দিয়েছিল। সেই প্রতিবেদনের পর তার বিরুদ্ধে কোনো ব্যবস্থা না নেওয়া হলেও এবার আর শেষরক্ষা হলো না।
একটি জেলার শীর্ষ পদে নিয়োগ নিয়ে এমন নজিরবিহীন আর্থিক লেনদেন ও ক্ষমতার অপব্যবহারের অভিযোগে প্রশাসনের সৎ ও নিষ্ঠাবান কর্মকর্তাদের মধ্যে তীব্র হতাশা ও ক্ষোভ বিরাজ করছে। অন্তর্বর্তীকালীন সরকারের সময়ে সুশাসন ও স্বচ্ছতা যখন সবচেয়ে বেশি প্রত্যাশিত, তখন এমন একটি ঘটনা সরকারের ভাবমূর্তিকে মারাত্মকভাবে প্রশ্নবিদ্ধ করেছে। এই ঘটনার একটি নিরপেক্ষ ও গভীর তদন্তের দাবি তুলেছেন প্রশাসনের বিভিন্ন স্তরের কর্মকর্তারা। তারা মনে করছেন, এই দুর্নীতির শিকড় আরও গভীরে এবং এর সঙ্গে জড়িত সব রাঘববোয়ালকে আইনের আওতায় আনা না গেলে প্রশাসনে স্বচ্ছতা ফেরানো সম্ভব হবে না।